ফুড স্টার্টআপ শুরু করার আগে কি কি বিষয় জানতে হবে ?
মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন আমরা ঘরে বসেই রেস্তোরাঁর খাবার অর্ডার করে খেতে পারি। ঘরে বসে খাবার অর্ডার করার এই প্রবণতা খাবারের ব্যবসায় এনেছে দারুণ পরিবর্তন এবং অনেকের জন্যই খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার দ্বার! অনেক উদ্যোক্তা, এমনকি গৃহিণীরাও এখন অনলাইনে খাবার সাপ্লাই বা ডেলিভারি দেওয়ার বিজনেসে নেমেছেন। এতে করে ঘরে বসেই উপার্জনের পথটি হয়ে গিয়েছে অনেকটা সহজ।
সাম্প্রতিক করোনাকালীন সময়ে অনেক উদ্যোক্তাই অনলাইনে ফুড স্টার্টআপ শুরু করেছেন। এর মূল সুবিধা হল এতে কম পুঁজি লাগে এবং ঘরে বসেই ঘরের কাজের পাশাপাশি উপার্জন করে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। আর ঘরে তৈরি খাবারের স্বাদ ও মান উভয়ই বাইরের রেস্টুরেন্টের চেয়ে ভালো ও উন্নতমানের, এইজন্য মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। যে কোনো ব্যবসা শুরু করার আগে সবচেয়ে বড় বাঁধা হল একটি মোটা অংকের পুঁজি । কিন্তু এই ধরণের অনলাইন ফুড স্টার্টআপে বড় অংকের পুঁজির দরকার পড়ে না, খুব কম টাকাতেই শুরু করা যায়। আর নিজে ভালো রান্না জানলে তো কথাই নেই! এই ধরনের বিজনেসে কোন রকম জায়গা ভাড়াও নেওয়া লাগে না। আপনি আপনার রান্নার কিচেন থেকেই সল্প পরিসরে এই বিজনেস শুরু করতে পারেন।
যে কোনো ব্যবসা শুরু করার আগে একটি পূর্ণ পরিকল্পনা করে নেওয়া উচিত। আর, আগে যদি অভিজ্ঞতা না থাকে তবে ছোট পরিসরে শুরু করাই ভালো । চলুন জেনে নিই এ ধরনের ফুড স্টার্টআপ শুরু করার আগে কি কি বিষয় বিবেচনা করতে হবেঃ
১। কী ধরনের খাবার বিক্রি করবেন?
আপনি কোন ধরনের খাবার বিক্রি করতে চান তা আগেই ঠিক করে নিন। এ বিষয়ে একটু রিসার্চ করে নেওয়া ভালো। মানুষ কোন ধরনের খাবার অনলাইনে বেশি অর্ডার করছে বা কোন খাবারের চাহিদা বেশি – সেই অনুযায়ী খাবার নির্বাচন করুন। শুরুতেই একাধিক মেন্যু না করে একটি বা দু’টি খাবার দিয়ে শুরু কররে পারেন। একটি প্রাথমিক মেনু ঠিক করে ধীরে ধীরে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী মেনুতে নতুন আইটেম যোগ করতে পারেন।
২। খাবারের দাম নির্ধারণঃ
অনলাইন ফুড স্টার্টআপের ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ করাটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । দাম নির্ধারণ করার আগে অন্যান্য অনলাইন পেজ, যারা আপনার মত একই খাবার বিক্রি করছেন, তাদের দাম গুলো দেখে নিন, এরপর নিজের খাবারের দাম নির্ধারণ করুন। মনে রাখবেনঃ আপনার খাবারের দাম অন্যান্য পেইজগুলোর তুলনায় খুব বেশি বা খুব কম দাম যেন না হয়। এমন ভাবে দাম ফিক্স করুন যাতে আপনারও লাভ হয় এবং ক্রেতারাও কিনতে আগ্রহী হয়।
এছাড়াও আপনি কোন এলাকায় খাবার ব্যবসা করতে চান তার উপরেও খাবারের দাম এবং মেনু নির্ভর করে। এ সকল কিছু বিবেচনায় রেখে খাবারের মূল্য নির্ধারণ করুন।
৩। অর্ডার নেওয়ার ব্যবস্থা বা ডেলিভারি কোম্পানি নেওয়াঃ
এই ধরনের ফুড স্টার্টআপের পুরো বিষয়টিই যেহেতু অনলাইন নির্ভর, তাই একটি ভালো ডেলিভারি প্লাটফর্ম সিলেক্ট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি কেক বা পেস্ট্রি এর মত সেনসিটিভ খাবার নিয়ে বিজনেস করেন তবে ডেলিভারি দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকবেন। ডেলিভারি কোম্পানি এর গাফিলতির কারণে আপনার পণ্য নষ্ট হলে তা সরাসরি আপনার বিজনেসের লোকসান করবে, সাথে নষ্ট হবে ব্যবসার ভাবমূর্তিও।
নানা প্রচলিত ফুড ডেলিভারি অ্যাপগুলো প্রতি অর্ডারে কিছু কমিশন নেয়। তাছাড়া নথিভুক্তির সময়ও এককালীন টাকা নেয় তারা। সেই সঙ্গে অনলাইন অর্থ পরিশোধের জন্য ভালো মানের পয়েন্ট অব সেল সিস্টেম (পিওএস) থাকা জরুরি।
প্রাথমিক ভাবে নিজস্ব লোকের মাধ্যমেও কাছাকাছি জায়গায় ডেলিভারি পাঠানো সম্ভব। তবে নিজেই অর্ডার নেয়া ও সরবরাহের দায়িত্ব নিলে খরচ ও ঝামেলা দুটোই বাড়বে। তাই প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র ফুড ডেলিভারি কোম্পানির ওপর নির্ভর করাই ভালো।
৪। প্যাকেজিংঃ
প্যাকেজিং একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ ধরনের ফুড স্টার্টআপের ক্ষেত্রে। প্যাকেজিং এমন হওয়া উচিত যাতে খাবার বেশিক্ষণ গরম থাকে এবং সহজে নষ্ট না হয়। কেক/পেস্ট্রি ধরনের পণ্য প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে নেওয়ার পথে খাবার নষ্ট না হয়, সাথে ডেলিভারি ম্যানকেও ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। প্যাকেজিং এ আপনার ব্র্যান্ডের লোগো থাকলে ভালো, এটি মানুষের নজর কাড়বে। একটু অন্য রকম কিছু করতে চাইলে প্যাকেজিং এর সাথে কিছু লিখে একটি ছোট নোট দিয়ে দিতে পারেন ক্রেতার জন্য।
৫। পরিচ্ছন্নতা এবং খাদ্যগুণ নিশ্চিত করাঃ
খাবার প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে হাইজিন বা পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী । ফ্রেশ সবজি ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে খাবার প্রস্তুত করবেন। প্যাকেটজাত জিনিস বা মশলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেয়াদ দেখে নেবেন। কোন মতেই বাসি খাবার ডেলিভারি দেবেন না। অল্প কিছু লাভের আশায় নিজের বিজনেসের সুনাম নষ্ট করতে দেওয়া উচিত না। আপনার সাথে কোনো সাহায্যকারী কর্মী থাকলে তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাও নিশ্চিত করুন।
৬। অর্ডারের হিসাব রাখাঃ
প্রতিদিন কতটি পণ্য অর্ডার হলো বা কত টাকার বাজার করা হল এগুলোর হিসাব খুব সূক্ষ্ম ভাবে রাখতে হবে যাতে করে লাভ-ক্ষতির পরিমাণ বুঝা যায়। প্রতিটি অর্ডার সঠিকভাবে এবং সময়মত ডেলিভারি দিতে হবে। ভুল অর্ডার বা একজনের অর্ডার আরেকজনের কাছে দেওয়া যাবে না। যদি কোনো কারণে ভুল হয়েও যায় তবে গ্রাহকের কাছে বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, এবং অতি দ্রুত ক্ষতিপূরণ বা সমস্যার সমাধান দিতে হবে। সব অর্ডারের হিসাব রাখতে সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন।
৭। মার্কেটিংঃ
যে কোনো বিজনেসের ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে অনলাইনে বিজনেস শুরু করতে হলে মার্কেটিং বা প্রচার প্রসার করা অত্যন্ত জরুরী। আর ফুড স্টার্টআপের মূলমন্ত্র হচ্ছে সুস্বাদু খাবার। খাবার ভালো হলে মানুষের মুখে মুখেই প্রচার প্রসারের কাজটি হয়ে যায়। ইদানিং বিভিন্ন গ্রুপে মানুষ রিভিউ দিয়ে থাকে। এসকল রিভিউ থেকেও ব্যাপক প্রচার প্রসার হয়ে থাকে। অনলাইন পেইজ বা ওয়েবসাইট খোলার পাশাপাশি একটি ফেইসবুক গ্রুপও খুলতে পারেন যেখানে আপনি আপনার রেগুলার কাস্টমারদের সাথে যুক্ত থাকবেন, তাদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে খাবারের ছবি ও রিভিউ দিতে উৎসাহিত করবেন। এতে করে আপনার প্রচার প্রসার বাড়বে । বিশেষ উপলক্ষগুলোতে ছাড়ের ব্যবস্থা রাখতে পারেন। রিভিউ দেওয়ার জন্যও বিশেষ ছাড় রাখতে পারেন। এছাড়া আপনি চাইলে রান্নার ইউটিউব চ্যানেলও খুলতে পারেন। এ থেকে খানিকটা বাড়তি আয়ও হতে পারে। যতো বেশি সংখ্যক ফুড ডেলিভারি অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন ততো ভালো। এতে অনলাইনের আপনার উপস্থিতি বাড়বে। এছাড়া আপনার ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে গুগোল ম্যাপে আপনার অবস্থান দেখিয়ে দিন। গ্রাহক যতো সহজে আপনার রেস্টুরেন্ট অনলাইনে খুঁজে পাবে ততো বেশি অর্ডার পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
যে কোনো ফুড স্টার্টআপ শুরুর আগে উপরের বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল উদ্যোক্তা। আর দেশ-বিদেশের দারুণ সব খাবারের রেসিপির জন্য পুষ্টি হোম শেফ তো সবসময়ের মতো আছেই আপনার পাশে!